চলার আগেই সুদে ব্যয় ৬০০০ কোটি

Passenger Voice    |    ১০:৫৮ এএম, ২০২৪-০৪-২৪


চলার আগেই সুদে ব্যয় ৬০০০ কোটি

এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল মেট্রোরেল ছিল বাংলাদেশের এমআরটি-৬, এখন সেটিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে এমআরটি-৫ (সাউদার্ন)। এতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়বে ৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকার বেশি। ভারতের বিভিন্ন শহরে যেসব মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের এ প্রকল্পটি অন্তত ছয় গুণ বেশি ব্যয়ে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।

রাজধানীর মানুষের যাতায়াতের সুবিধার জন্য সবচেয়ে যুগান্তকারী প্রকল্প হিসেবে ধরা হয় মেট্রোরেল প্রকল্পকে। এমআরটি-৬ চালু হওয়ার পর এবার মেট্রোরেলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এমআরটি-৫ (সাউদার্ন) নামের প্রকল্পটিতে ব্যয় হবে ৫৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের ঋণে ১৭ দশমিক ২ কিলোমিটারের এ প্রকল্পটি অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রকল্প চলাকালেই সুদ ও ঋণ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হবে ৬ হাজার কোটি টাকা, যা আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলা পরিপন্থী বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। গতকাল মঙ্গলবার প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, এ প্রকল্পটিতে বেশ কিছু খাতে ব্যয় খুব বেশি ধরা হয়েছে। এতে আপত্তি তুলেছে কমিশন; বিশেষ করে পরামর্শক, ঋণ, সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয়সহ বিভিন্ন ব্যয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি রয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এর আগে এ প্রকল্পটির এইড মেমোয়ারে বিদেশি ঋণ, সরকারি ঋণসহ মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৫২ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) ২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যয় প্রাক্কলনের ব্যাপক পার্থক্যের কারণ কী, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পে শুধু এডিবি ও কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের ঋণই রয়েছে ৩৯ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। বাকি ১৫ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা সরকারের ঋণ।

প্রকল্পের ব্যয় এত বেশি কেন জানতে চাইলে অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক সেখ খলিলুর রহমান বলেন, ‘আপনি শুধু তথ্য জানতে চাইতে পারেন। কিন্তু এত বেশি ব্যয় কেন সেটি দেখবে সরকার, এটি আপনার কনসার্ন না। আপনি এটি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন না।’

সরকার এমন এক সময়ে এত বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিও নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

এই প্রকল্প চলাকালেই শুধু এডিবির ঋণের কমিটমেন্ট চার্জ দিতে হবে ২০৩ কোটি টাকা, ডলারের অঙ্কে যা প্রায় ২ কোটি ডলার। এ ছাড়া নির্মাণের সময়ই প্রকল্পটির ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা, ডলারের হিসাবে যা প্রায় ৫৪ কোটি ডলার; অর্থাৎ প্রকল্প চলাকালেই শুধু সুদ ও কমিটমেন্ট চার্জেই ব্যয় হবে ৬ হাজার ৫০ কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এ প্রকল্পটিতে ঋণ ও সুদ পরিশোধে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তা সংযোজন করাই আর্থিক ও পরিকল্পনার শৃঙ্খলা পরিপন্থী। এ দুটি খাত সংযোজন করে অহেতুক ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে।

এই প্রকল্পের পরামর্শক ব্যয়ই ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি খাত থেকে ধরা হয়েছে ৪৫৯ কোটি টাকা, প্রকল্প ঋণ থেকে ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে, এডিবির অর্থায়নকৃত প্রজেক্ট রেডিনেস ফাইন্যান্সিং (পিআরএফ) প্রস্তাবিত এ প্রকল্পটির জন্য বিস্তারিত প্রকৌশল নকশা প্রণয়ন করা সত্ত্বেও এই প্রকল্পের আওতায় এত বিপুল পরিমাণ পরামর্শক সেবার সংস্থান রাখা অযৌক্তিক।

এত বেশি পরামর্শক ব্যয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) এমদাদউল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ যুক্তি দিয়েছে যে টেকনিক্যাল বিভিন্ন বিষয়ের কারণে এ খাতে তাদের ব্যয় বেশি রাখা হয়েছে। আমরা তাদের প্রশ্ন করেছি।’

এই প্রকল্পে ৩৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু এই পরিমাণ ভূমি কোথায় কোন কাজে ব্যবহার করবে তা স্পষ্ট করা হয়নি। প্রকল্পের উদ্দেশ্যের সঙ্গে জমি অধিগ্রহণের সম্পর্ক কী, তা-ও স্পষ্ট করা নেই ডিপিপিতে। এ ছাড়া ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা সংস্থান রাখা হয়েছে প্রকল্পে। এই ক্ষতিপূরণ কারা পাবেন, এর ভিত্তি কী, তা-ও স্পষ্ট করেনি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।

প্রকল্প সূত্র বলছে, এমআরটি-৫ (সাউদার্ন) ঢাকা মহানগরীর দ্বিতীয় পূর্ব-পশ্চিম সংযোগকারী মেট্রোরেল; যার মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ দৈনিক প্রায় ৯ লাখ ২৪ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। প্রতিটি একমুখী মেট্রোরেল ৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ড পরপর যাত্রা শুরু করে ১৫টি স্টেশনে থেমে ২৮ দশমিক শূন্য ২ মিনিটে গাবতলী থেকে ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ার, কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত যাতায়াত করবে। প্রতিটি ট্রেনের সর্বোচ্চ যাত্রী ধারণক্ষমতা ২ হাজার ৩১২ জন।

এডিবির সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০৩০-৩১ অর্থবছরে যাত্রীরা এই মেট্রো ব্যবহার করলে ২১ কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে। বছরে জ্বালানি সাশ্রয় হবে ৪১ দশমিক ২২ হাজার টন। রাস্তার গাড়ি চলাচলের মাধ্যমে অতিক্রান্ত দূরত্ব বছরে ৬৪২ হাজার কিলোমিটার হ্রাস পাবে। রাস্তায় ১ হাজার ৪৯টি গাড়ির চলাচল কমে যাবে। বায়ুতে ১৬ দশমিক ১৯ হাজার টন কার্বন নির্গমন কমে যাবে। অন্যান্য গ্যাসের নির্গমন ৫ দশমিক ৭৩ হাজার টন কমবে।

এমদাদউল্লাহ মিয়ান বলেন, যোগাযোগ খাতে সরকারকে অনেক টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। যেহেতু এমআরটির একটি প্রকল্প দিয়ে সরকার সুফল পাচ্ছে। দ্বিতীয়টি ব্যবসায়িক চিন্তায় লাভবান না হলেও জনগণের কথা চিন্তা করে সরকার এটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘কিছু বিষয়ে আমাদের প্রশ্ন ছিল, আমরা তা জানতে চেয়েছি। যেগুলোর ব্যয় বেশি, সেগুলো কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিছু বিষয় বাদ এবং কিছু সংযোজনের কথাও তাদের বলা হয়েছে।’

দেশের মেট্রোর কোন প্রকল্পে কত ব্যয়

অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এমআরটি-৫ (সাউদার্ন) বাংলাদেশের মেট্রোরেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল প্রকল্প। সদ্য চালু হওয়া সফল প্রকল্প এমআরটি-৬-এ ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। ২১ দশমিক ৬ কিলোমিটারের এই মেট্রোতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। সবচেয়ে দীর্ঘ, অর্থাৎ ৩১ দশমিক ৬ কিলোমিটারের এমআরটি লাইন-১-এ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। এমআরটি লাইন-৫ (নর্দার্ন) প্রকল্পটি ২০ কিলোমিটারের, এতে ব্যয় হবে ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার বেশি। এখানে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ২ হাজার ৬১ কোটি টাকা।

অন্যান্য দেশে ব্যয় কেমন

পাশের দেশ ভারতের বেঙ্গালুরুর মেট্রোরেল পেজ-১ বাস্তবায়ন হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ৫৪০ কোটি টাকায়। এ ছাড়া জয়পুর মেট্রোরেল পেজ-২ ৩৪৬ কোটি টাকায়, হায়দরাবাদ মেট্রোরেল ৩১৬ কোটি টাকায় ও আহমেদাবাদ মেট্রোরেল ৪২০ কোটি টাকায় বাস্তবায়িত হয়েছে।

কলকাতা ইস্টওয়েস্ট মেট্রোরেলের এক্সটেনশন হুগলি নদীর নিচ দিয়ে হাওড়া রেলস্টেশনকে যুক্ত করেছে। পুরো আন্ডারগ্রাউন্ডের এই ১০ দশমিক ৮ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৫৭৬ কোটি রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১১ হাজার ৩২০ দশমিক ৩২ কোটি টাকা। গত ৬ মার্চ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এটির উদ্বোধন করেছেন। এই প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৪৮ দশমিক ১৮ কোটি টাকা।

বিশ্বরেকর্ড করা দুবাই মেট্রোর চালকবিহীন ৭৫ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে বাংলাদেশি মুদ্রায় ব্যয় হয়েছে ৫৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ৭০৯ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা।

ঢাকার প্রথম মেট্রো নির্মাণে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে প্রথম মেট্রো তৈরি হয় ভারতের দিল্লিতে। ঢাকা এমআরটি-৬-এর অর্ধেকের কম খরচে লাহোরে প্রথম মেট্রো তৈরি করেছে পাকিস্তান। অন্যদিকে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে প্রথম মেট্রো তৈরি করেছে চীন। দেশটির সাংহাই শহরের প্রথম মেট্রোটির নির্মাণ ব্যয় ঢাকার এমআরটি-৬-এর নির্মাণ ব্যয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। নির্মাণকাজ চলমান আছে এমন প্রকল্পগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরের ‘লাইন-২-এ’ ও হো চি মিন সিটির ‘এইচসিএমসি লাইন-১’-এর নির্মাণ ব্যয় ঢাকার এমআরটি-৬-এর তুলনায় অনেক কম।

প্রথমবার মেট্রো নির্মাণে এখন পর্যন্ত এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিঙ্গাপুরের নর্থ-সাউথ লাইন। লাইনটির প্রায় ছয় কিলোমিটারের প্রথম অংশটি তৈরি হয়েছিল ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে। সে সময় এই মেট্রোরেল লাইন তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ৩৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। তখন ১ সিঙ্গাপুর ডলারের বিপরীতে ডলারের মান ছিল দশমিক ৪৭। ২০১৯ সালে ১ সিঙ্গাপুর ডলারের বিপরীতে মার্কিন ডলারের মান বেড়ে দাঁড়ায় দশমিক ৭৪। ২০১৯ সালের ডলারের মান অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরে প্রথম মেট্রোটি তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ৯৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় ১৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।

প্যা/ভ/ম